কী আছে পুলিশের সংস্কার প্রস্তাবে?
জুলাই-আগস্টে হতাহতের জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাসি্তর সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পাশাপাশি পুলিশ যেন রাজনৈতিক দলের বাহিনীতে পরিণত না হয় এবং বেআইনি বল প্রয়োগ না করতে পারে এমন বিধান রেখে বিদ্যমান আইন সংস্কারের সুপারিশও করা হয়েছে। এছাড়া স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী, পুলিশ পরিচালিত হবে এই কমিশনের মাধ্যমে। কমিশনে জাতীয় সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুজন করে সদস্য থাকবে। পুলিশ সংস্কার কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বুধবার পুলিশ সংস্কার কমিশনসহ চারটি সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদষ্টো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন।
সফর রাজ হোসেন বলেন, ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পুলিশকে তিন হাজারের বেশি আইন নিয়ে কাজ করতে হয়। সব আইন খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে এ ২২টি আইনের সংশোধন, পরিমার্জন বা কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। ওই ২২টি আইনের কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের আপত্তি আছে, সেসব বলে দিয়েছি। তিনি বলেন, ভিড় বা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন আছে। এটার ব্যাপারে আমরা কোনো আইডিয়া দিইনি। ইউরোপের মডেলটাই ফলো করতে বলেছি। সেটার ব্যপারে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ডিটেল একটা গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘ইউজ অব ফোর্স’ ৫টা স্তরে হবে। বেআইনি সমাবেশ, শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে যে শক্তি প্রয়োগ করা হয়, এ শক্তি প্রয়োগটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্রাউডের ক্ষেত্রে কী কী করতে হবে। ভবিষ্যতেও যদি কোনো ঘটনা ঘটে, কেউ প্রাণহীন হবে না।
তিনি বলেন, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে। সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে হয়তো জনসাধরণের কষ্ট লাঘব হতো। এক্সেসিভ ফোর্স ব্যবহার, নির্বিচারে কোনো গ্রেফতার করতে পারত না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটার একটা রিভিউ পিটিশন দেওয়া আছে, যার ফলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনুরোধ করেছি, সরকার যেন এটি উইথড্রো করে, তাহলেই ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এটার জন্য যেটা প্রয়োজন, আইন মন্ত্রণালয় হয়তো করবে।
সফর রাজ হোসেন বলেন, প্রতিটি থানায় নারী পুলিশের জন্য একটি ডেস্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই ডেস্কে ২৪ ঘণ্টা যেন একজন নারী সাব-ইনস্পেকটর থাকেন, এসআই থাকেন, কনস্টেবল থাকেন। যাতে মহিলা আসামিকে জেরা করা, কোর্টে আনা-নেওয়া করা এবং নারী অভিযোগকারী যদি আসেন, এজন্য সুপারিশ করেছি। হয়তো দীর্ঘসময় লাগবে; কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য। এ সুপারিশগুলো অবিলম্বে, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য বলে জানান সংস্কার কমিশনের প্রধান। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে আর্থিক ব্যবহার বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আইন পরিবর্তন করতে হতে পারে।
চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো শিগ&গিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন সফর রাজ প্রধান। তিনি বলেন, এটার ক্ষেত্রে খুব ইজি করা সম্ভব। কারণ, এখন ন্যাশনাল আইডি কার্ড হয়েছে। চাকরির সময় আত্মীয়স্বজন রাজনীতি করে কি না, এটা দেখা হতো। এসবির সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সুপারিশ করেছি যাতে সহজ হয় ভবিষ্যতে। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তারা হয়তো আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি পরিবর্তন করবে। স্বরাষ্ট্র উপদষ্টো, তিনি তো রাজিই আছেন।
উলে্লখ্য, গত বছরের ৩ অক্টোবর সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন গঠিত কমিশনকে প্রধান উপদষ্টোর কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী ২ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমার কথা ছিল। পরে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মেয়াদ একদফা বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। পুলিশ সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষের মত নিয়েছিল কমিশন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেয়।
পুলিশ সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, কমিশনের সুপারিশে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের অধীন একটি পর্যালোচনা কমিটি রাখার কথা বলা হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে ওই কমিটি তা তদন্ত করবে। এছাড়া পুলিশে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা বা Èফিট লিস্ট’ করা, পুলিশে আলাদা মেডিকেল কোর ও টেকনিক্যাল কোর করারও সুপারিশ করা হয়েছে।