সংবাদ মাধ্যম

রাজনীতি ও দালালি সাংবাদিকতা: সত্যের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়

ফারুকুল ইসলাম, দৈনিক দৈনিক ঢাকা প্রতিদিন

সাংবাদিকতাকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়-এ কথা কেবল বইয়ের বাক্য নয়; প্রতিদিনের বাস্তবই তার সাক্ষ্য দেয়। সত্য অনুসন্ধান, জনস্বার্থ রক্ষা এবং ক্ষমতার ওপর নজরদারি-এই তিন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই সাংবাদিকতা সমাজে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ভয়াবহ প্রবণতা ক্রমেই মাথাচাড়া দিচ্ছে-দালালি সাংবাদিকতা। এই প্রবণতা শুধু পেশার নিরপেক্ষতাকেই ধ্বংস করছে না, বরং গণমাধ্যমের প্রতি জনবিশ্বাসকেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

রাজনীতির মাঠে সুবিধাবাদী সাংবাদিকতার উত্থান
যখন রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাব গরম হয়, তখন কিছু সুযোগসন্ধানী সাংবাদিক ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান রক্ষা বা সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের কাজ হয়ে যায় ক্ষমতাবানদের কথাকে খবর বানানো, তাদের ভাবমূর্তি রক্ষা করা, কিংবা তাদের প্রচারণাকে “সংবাদ” হিসেবে পরিবেশন করা।
ফলে জনস্বার্থের পরিবর্তে গুরুত্ব পায় নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ-আর সত্য ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়।

এর ফলে মারাত্মক-প্রকৃত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হারিয়ে যায়, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ অদৃশ্য হয়ে যায়, আর প্রভাবশালীদের পিআর কার্যক্রমই “ব্রেকিং নিউজ” হয়ে ওঠে।

মাঠের সাংবাদিকদের সংগ্রামকে ভুলে গেলে চলবে না
তবে এ কথাও সত্য-সাংবাদিক সমাজের বড় অংশ এখনো নীতিতে অটল। মাঠে ঘাম ঝরিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে, রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে তারা প্রকৃত সংবাদ পাঠকের সামনে তুলে ধরছেন।

দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীত- সবকিছুই তারা আলোচনায় আনছেন, যদিও তাদের সামনে থাকে হামলা, মামলা, হুমকি আর চাপের ভয়।
তবুও তারা থেমে যান না। কারণ তারা জানেন-সততার সাংবাদিকতা থামলে গণতন্ত্র থেমে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ প্রবণতা: “মাইক্রোফোন দালালি” আজকাল সবচেয়ে চোখে পড়া প্রবণতা হলো-মাইক্রোফোন দালালি।
যেখানে সাংবাদিকের কাজ প্রশ্ন করা, সেখানে দেখা যায় তারা নেতাদের বক্তব্যে প্রশংসার মালা গাঁথছেন।

যেখানে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার কথা, সেখানে “সুবিধামতো” নেওয়া বক্তব্যকেই খবর বানানো হয়।

এই আচরণ শুধু সংবাদ বিকৃত করে না-পুরো সাংবাদিকতা পেশার ওপরই প্রশ্ন তোলে।
একটি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করতে গিয়ে তারা গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা ধ্বংস করছেন।

দালালি সাংবাদিকতা সমাজকে অন্ধ করে দেয় একটি সুস্থ সমাজে সমালোচনা, প্রশ্ন, এবং জবাবদিহিতা-এই তিনটি অপরিহার্য।

রাজনীতি যদি ক্ষমতার প্রতিযোগিতা হয়, তবে সাংবাদিকতা সেই ক্ষমতার ওপর জনগণের চোখ।
কিন্তু দালালি সাংবাদিকতা সেই চোখকে অন্ধ করে দেয়।
আর অন্ধ চোখ কখনোই সত্য খুঁজে পায় না।

সত্য ও নৈতিকতার সাংবাদিকতাই গণতন্ত্রের শক্তি
মনে রাখতে হবে-নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা এবং সত্যনিষ্ঠতার ওপর দাঁড়ানো সাংবাদিকতাই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
দালালি সাংবাদিকতা যত বাড়বে, রাজনীতিতে অস্বচ্ছতা তত বাড়বে, জনবিশ্বাস তত কমবে।

সততার সাংবাদিকতাই পথ দেখাবে সত্যের পথে থাকা সাংবাদিকরা কখনোই দালালি বা পক্ষপাতিত্বের কাছে মাথা নত করেন না। তাদের কলম শুধু ক্ষমতার মুখোমুখি নয়-তারা জনগণের কণ্ঠস্বর।

তাই সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজন-কঠোর নৈতিক মানদণ্ড, পক্ষপাতহীনতা, রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করার সাহস, জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।

সততার সাংবাদিকতা টিকে থাকলে রাজনীতিতেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে।

সত্য কখনো হারায় না-শুধু প্রয়োজন সাহসী কণ্ঠ, যারা সত্যকে তুলে ধরতে পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button