প্রতিকূলতার মধ্যেও সাংবাদিকতা টিকে থাকা বড় অর্জন
অনলাইন নিউজ ডেস্ক, সোনারগাঁ টাইমস২৪ ডটকম :
দেশে সাংবাদিকতা নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও টিকে থাকা বড় অর্জন। অর্জনের এই পাল্লা আরও ভারী করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, সত্যিকারের গণতন্ত্র থাকলেই সংবাদপত্র টিকে থাকবে। তাই সবাই মিলে সত্যিকারের গণতন্ত্র তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও সহনশীল হতে হবে।
সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘৫০ বছরের বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের অর্জন ও আগামীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে সম্পাদক ও শিক্ষকেরা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই আলোচনা সভা।
আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাংবাদিকতায় মুক্তিবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্ধকতা, কাগজসহ অন্যান্য উপকরণের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি, বিজ্ঞাপনের অপ্রতুলতা অথবা শর্তযুক্ত বিজ্ঞাপনের বিষয় আছে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের কর্মী ও সম্পাদকেরা যদি রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে পড়ে যান, তাহলে সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। আদর্শিক রাজনীতি করার অধিকার প্রত্যেকের আছে। কিন্তু দলীয় রাজনীতি সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের মধ্যে দলীয় রাজনীতি, শিক্ষকদের মধ্যে তো আছেই। এখন সাংবাদিকেরা যদি দলীয় রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ফেলেন, তাহলে সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতা চলে যাবে। ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হবে।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমের অর্জন প্রচুর। যেমন গণমাধ্যম শিল্প হিসেবে মোটামুটি দাঁড়াচ্ছে। যদিও এখনো শিল্প বলা যাবে না। কিন্তু শিল্পের ধারেকাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করছে। যতই এটি শিল্পের মর্যাদায় চলে যাবে, ততই দেখা যাবে তার ভূমিটা শক্ত হবে। সংবাদপত্রের এখনো দুটি সংস্করণ চলছে। মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ। অনেকের ধারণা ছিল মুদ্রিত সংবাদপত্রের দিন বুঝি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দেশে দেখা যাচ্ছে তা শেষ হয়নি। অনলাইনে সংবাদপত্র দেখছে, তারপরেও সকালে সংবাদপত্রটি পড়া হচ্ছে।
এক তরুণের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এক তরুণ তাঁকে বলেছেন, তাঁর দিনটা তৈরি করে দেয় সংবাদপত্র। তরুণদের কাছে এখনো সংবাদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা আছে, এটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রতিকূলতার মধ্যে সংগ্রাম করে থাকাটাই একটি বড় অর্জন।
তবে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বেতন পর্যাপ্ত নয় বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তরুণ সাংবাদিকদের যে বেতন, তা বোধ হয় খুব কম চাকরিতেই আছে। তা–ও অনেকটা অনিয়মিত। সাংবাদিকদের যদি ভালো বেতন-ভাতার ব্যবস্থা হতো, যদি প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ এবং লেগে থাকার জন্য যেসব শর্ত লাগে, সেগুলো পূরণ করার ব্যবস্থা থাকলে, তাহলে হয়তো সংবাদপত্র বিকাশ আরও ভালো হতো। এটিও ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। সাংবাদিকদের সমিতি অনেক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলের মতো বিভাজন। এ কারণে সাংবাদিকদের দাবিগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রেস কাউন্সিলকে আরও উজ্জীবিত করার আহ্বান জানান। সাংবাদিকতা কখনো যেন হলুদ রং ধারণ না করে, সে বিষয়েও সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনারারি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, সাংবাদিকতায় প্রতিকূলতার শেষ নেই। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। দৈনিক সংবাদপত্র এখন আর সাদামাটা সংবাদ দিয়ে চলবে না। তিনি বলেন, সত্যিকারের গণতন্ত্র যদি থাকে, তাহলে সংবাদপত্র টিকে থাকবে। তাই সবাই মিলে সত্যিকারের গণতন্ত্র তৈরি করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম সাংবাদিকতার বিকাশের জন্য কয়েকটি দাবি বা অনুরোধ জানান। এর মধ্যে বিচার বিভাগের কাছে অনুরোধ করে তিনি বলেন, মানহানির ঘটনায় আইনে স্পষ্ট বলা আছে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা হতে পারে না। আর মানহানির ক্ষেত্রে শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করতে পারেন। তাহলে কেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একই ঘটনার জন্য অনেক অনেক মামলা হয়? যাঁরা সংক্ষুব্ধ নন, তাদের মামলাও গ্রহণ করা হয়, এটি কি আইনের অমান্য হলো না? সাধারণ নাগরিক ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা করা কি আপনাদের দায়িত্ব নয়?
নির্যাতনমূলক আইনগুলো আবারও পুনর্বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে সরকারের কাছে দাবি জানান মাহ্ফুজ আনাম। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যত্রতত্র ব্যবহার হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সংবাদপত্রের মালিকদের কাছে মাহ্ফুজ আনাম অনুরোধ করে বলেন, এই শিল্প ভিন্ন প্রতিকৃতির, এই শিল্প পরিচালনার জন্য ভিন্ন মানসিকতার প্রয়োজন, দয়া করে সেটি অনুধাবন করুন। সাংবাদিকদের সম্মান দিন, তাঁকে অন্য কারখানার লোক হিসেবে চিন্তা করবেন না। সর্বোপরি সম্পাদককে মন থেকে শ্রদ্ধা করুন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিন। সাংবাদিকদের প্রতি আবেদন, আপনারা পেশার মহত্ত্ব ও গুরুত্ব হৃদয় থেকে অনুধাবন করুন। আর সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা যে পদ অলঙ্কিত করছেন, তা যত সম্মানের হবে, সংবাদপত্রও তত বেশি সম্মানের হবে। সাংবাদিকতা তত বেশি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
সাংবাদিকতার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে
সম্পাদক পরিষদের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইদানীং সরকার থেকে শুরু করে দুর্বৃত্ত সবার প্রতিপক্ষ সাংবাদিক। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সরকারের সহযোগিতা না থাকলে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। সমাজ যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেগুলো ভেঙে পড়েছে। কিসের ওপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতা চলবে? তবে সাংবাদিকতা একটি নিরন্তর লড়াই, সে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, বড় বড় শিল্পপতিরা সংবাদপত্র শিল্পে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকে আসছেন নিজের স্বার্থ রক্ষায়। তাঁরা গণমাধ্যমের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করবেন, এটা ভাবার কারণ নেই। কে গণমাধ্যমের মালিক হতে পারবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। যে কেউ গণমাধ্যমের মালিক হতে পারেন।
শ্যামল দত্ত প্রশ্ন রাখেন, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থা যখন প্রবলভাবে শাসন করে, তখন গণমাধ্যম কীভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করবে? সংসদ, বিচার বিভাগ কি যথাযথভাবে কাজ করছে? নির্বাহী বিভাগ দলীয় আনুগত্যের একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের সামনে। সংবাদপত্র চলে মূলত বিজ্ঞাপনের আয় থেকে। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংবাদ গেলে তারা বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। সরকারের বিরুদ্ধে গেলে সরকার বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেয়। তাহলে সংবাদপত্র চলবে কীভাবে?
সমকাল–এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, গণমাধ্যম নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও গণমাধ্যমের অর্জনও কম নয়। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা ঐক্য ধরে রাখতে পারেননি। দলীয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সাংবাদিকদের বিভাজন প্রকট করেছে।
নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ১৯৯০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময় তুলনামূলক ভালো ছিল। তবে সেটাও আদর্শ সময় ছিল না। গণতন্ত্র থাকলে সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটে, আর সাংবাদিকতা ঠিক থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হয়। এখন সাংবাদিকতা ম্রিয়মাণ। গণতন্ত্র সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। তিনি বলেন, কোনো সাংসদ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যথার্থ সমালোচনা হলেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়। সেখানে সরকারের কাছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাওয়া একধরনের দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়।
চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, সংবাদমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ পাঠক ধরে রাখা, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ। সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন গ্রাহকের জন্য কিছু ধার্য (অর্থ) করা উচিত।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে মন্তব্য করেন ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান।
আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। অনুষ্ঠানে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র: প্রথম আলো