সারাদেশ

শীতের শুরুতেই বাঁশখালীর মৎস্যচাষীরা শুঁটকী পল্লীতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে

শিব্বির আহমদ রানা, চট্টগ্রাম (বাঁশখালী) প্রতিনিধি:

শীতের শুরুতেই বাঁশখালীতে মৎস্যচাষীরা শুঁটকি উৎপাদনে শুঁটকী পল্লীতে ব্যস্ত সময় পার করছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চল বাঁশখালী উপজেলা। উপকূলীয় এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবীকার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র বঙ্গোপসাগর। এখান থেকেই তারা মৌসুম ভিত্তিক মৎস্য আহরণ করে থাকে। জেলে পাড়ার মানুষের কর্মসংস্থান কেবল সমুদ্র কেন্দ্রীক। অক্টোবর মাসের শুরুতেই মৎস্য ব্যবসায়ীরা গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেয় মাছ আহরণে। শীতের মৌসুম একমাত্র মৎস্য শুকানোর উপযুক্ত বলে ব্যবসায়ীরা শুঁটকিচাষে ব্যস্ত সময় পার করে। ইতোমধ্যেই বাঁশাখালীতে অর্ধশত কেল্লায় শুঁটকি উৎপাদন পুরোদমে শুরু হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাঁশখালী থেকে ২০-২৫ কোটি টাকার শুঁটকি বিদেশে রফতানি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে শুঁটকী চাষে সংশ্লিষ্টরা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাঁশখালীর সুস্বাদু ও বিষমুক্ত শুঁটকি বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও রফতানি হয়ে আসছে। বর্তমানে বাঁশখালীর জেলে পল্লীতেগুলোতে শুঁটকি শুকানোর ধুম পড়েছে। উপজেলার ছনুয়া, বড়ঘোনা গন্ডামারা, পুঁইছড়ি, নাপোড়া, শেখেরখীল, শিলকুপের মনকিচর, জালিয়াখালী বাজার সংলগ্ন শুঁটকী পল্লীতে, সরল, বাহারছড়া ও খান-খানাবাদের সাগর ও নদীর চরগুলোতে অর্ধশত শুঁটকি মহালে প্রায় ৬-৭ হাজার জেলে শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।

জানা গেছে, অন্যান্য এলাকার জেলেরা ইউরিয়া সার, লবণ ও বিষাক্ত পাউডার দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে থাকে। শুঁটকি উৎপাদনে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করার কারণে এসব শুঁটকি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি ওইসব শুঁটকি খেতেও তেমন স্বাদ পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাঁশখালীর শুঁটকিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় এখানকার শুঁটকির স্বাদ ও কদর যেন আলাদা। বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূলের জেলেরা কোন কিছুর মিশ্রণ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে তপ্ত রৌদ্রের তাপে শুঁটকি মাছগুলো শুকান বলেই বাঁশখালীর শুঁটকি খুবই সুস্বাদু এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়।

বাঁশখালীর জেলে পল্লীতেগুলোতে শুকানো শত শত মণ শুঁটকি ক্রয় করতে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, আসাদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারের গুদাম মালিকরা বাঁশখালীর শুঁটকী পল্লীতে হাজির হচ্ছেন এবং অনেকেই জেলেদের অগ্রীম টাকা দাদন দিয়ে যাচ্ছেন কাংঙ্খিত শুঁটকির জন্য। শহর থেকে নিয়মিত ৪০ এর অধিক পাইকার ও ৩০০ এর অধিক শহুরে খুচরা ক্রেতা নিয়মিত শুঁটকী নিয়ে যায় বাঁশখালীর বিভিন্ন শুঁটকীর কেল্লা থেকে। ক্রেতাদের কাছে বাঁশখালীর শুঁটকির আলাদা সুনাম থাকায় অন্যান্য এলাকার শুঁটকি এখন বাঁশখালীর শুঁটকি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতাও শুরু হয়েছে বাজারে এমনটি জানান শুঁটকী ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে বাঁশখালীর সুনাম ক্ষুন্ন করার পাঁয়তারা হলেও এখানকার শুঁটকির জনপ্রিয়তা কোনক্রমেই কমছে না বলে জানান উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট জেলেরা।

চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জের শুঁটকি মাছের পাইকার ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকদের সাথে কথা বলে জানাযায়, প্রতিবছর বাঁশখালী থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় কয়েক কোটি টাকার শুঁটকি। চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারসহ বড় বড় গুদামে হাজার হাজার মণ শুঁটকি গুদামজাত করে বর্ষা মৌসুমেও উচ্চদামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে অনেক ব্যবসায়ী লাভবান হন। সাগর থেকে জেলেদের আহরণ করা মাছ আধুনিক পদ্ধতিতে শুকানোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর সাগর উপকূলে লাখ লাখ টাকার মাছ বিনষ্ট হয়।।আশানুরুপ উৎপাদনে তাই শুঁটকী চাষীদের উন্নত ও আধুনিক চাষাবাদে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নাই বলে জানান তারা।

শেখেরখীলের বিখ্যাত শুঁটকী চাষী মো. রেজাউল করিম বহদ্দার জানান, বাঁশখালীতে উৎপাদিত শুঁটকির মধ্যে লইট্যা, ছুরি, রূপচান্দা, ফাইস্যা, মাইট্যা, কোরাল, রইস্যা, পোঁহা ও চিংড়ী শুঁটকি অন্যতম। বাঁশখালীতে উৎপাদিত উন্নতমানের শুঁটকি দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব শুঁটকি এখন রফতানি হচ্ছে দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত ও পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এসব শুঁটকি রফতানি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে বাঁশখালীর ঘের মালিকসহ চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও চকবাজারের বড় বড় গুদাম মালিকরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাঁশখালী থেকে কয়েক কোটি টাকার শুঁটকি বিদেশে রফতানি হবে বলে বহদ্দাররা আশা প্রকাশ করেছে। আরেক মৎস্য চাষী আব্দুল গফুর বলেন, চলতি মৌসুমে সাগরে ইলিশের অবস্থা ভাল থাকলে অনেকে শুঁটকী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। কাঁচা মাছ বিক্রি করে অনেকে শুঁটকীর চেয়ে বেশী লাভবান হয়। তাছাড়াও এ অঞ্চলের কিছু কিছু শুঁটকী চাষীরা কেল্লা তৈরি করছে, মাছ অহরনে সাগরে ছুটেছে। শীত মৌসুমে তারা কাঙ্ক্ষিত মৎস্য শুঁকিয়ে ভাল দামের প্রত্যাশা করছে।

শুঁটকী চাষীরা আরো জানান, বাঁশখালীর জেলেরা শুঁটকি উৎপাদন করতে সরকারি-বেসরকারি কোন সাহায্য-সহায়তা পায় না। নিজ উদ্যোগে এবং জীবনের তাগিদেই তারা কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করে। শুঁটকি উৎপাদনকারী জেলেদের কোন পৃষ্ঠপোষকতা বা ব্যাংক ঋণ সুবিধা না থাকায় তারা ধর্না দেন চট্টগ্রাম শহরের গুদাম মালিকদের নিকট। জেলেরা বড় বড় গুদাম মালিকদের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা দাদন এনে এসব শুঁটকি শুকানোর কারণে স্বল্প মূল্যে শুঁটকিগুলো গুদাম মালিকদের হাতে তুলে দিতে হয়। বাঁশখালীর প্রায় হাজার হাজার জেলের অন্যতম আয়ের উৎস ওই শুঁটকি চাষ। শুঁটকী চাষে রয়েছে অনেক সমস্যা। মাছ শুকানোর জন্যে প্রয়োজন বিশাল এলাকা। যেখানে গড়ে উঠে শুঁটকী পল্লীতে। এখন আগের মতো খোলা জায়গা তেমন পাওয়া যায় না। সীমাবদ্ধতা ও নানা সমস্যা থাকা স্বর্তেও ৬-৭ হাজার মৎসজীবীর সাথে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে জড়িত। শুকনো মওসুমে শুঁটকি শুকিয়ে তা গুদাম মালিকদের কাছে বিক্রয় করে চলে তাদের জীবন জীবিকা। তবে ভারতে উৎপাদিত ক্যামিক্যাল মিশ্রিত শুঁটকী বাংলাদেশের বাজারে সস্তায় পাওয়া যায়।

Related Articles

Back to top button