দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের মাফুসি কারাগার। ছোট্ট দেশটির এই কারাগারেই বন্দী আছেন প্রায় ৩ হাজার বাংলাদেশি। বিভিন্ন অপরাধে তারা গ্রেফতার হয়ে ভোগ করছেন সাজা। গত সপ্তাহে সেই কারাগার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। দেখা করেছেন কারাবন্দীদের সঙ্গে। দিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের পোশাক। অন্যদিকে ইউরোপের ছোট্ট দেশ মাল্টা। সেখানকার কারাগারেও বন্দী আছেন ১৫৬ বাংলাদেশি। তাদের অপরাধ- অবৈধভাবে মাল্টায় প্রবেশ ও অবস্থান। ইউরোপে যাওয়ার সময় মাল্টার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাজীবন পার করছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সেখান থেকে সুযোগ বুঝে ইউরোপের দেশ ইতালিতে প্রবেশ করা। জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করে মাল্টা পৌঁছানো এসব বাংলাদেশির রাজনৈতিক ও মানবিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে মাল্টা সরকার। এখন তাদের ফেরত পাঠাতে চায় মাল্টা। গত জানুয়ারিতে এমন ৪৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায়েছিল মাল্টা।
অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় মেক্সিকোর ভূখন্ড থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আটক হয়েছেন কয়েক শ বাংলাদেশি। বর্তমানে তারা মেক্সিকোর বিভিন্ন কারাগারে আটক। বাংলাদেশি বন্দীদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এই বন্দীর সঠিক সংখ্যা না থাকলেও গত ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে যথাক্রমে ১৪৯, ১৬৭, ৩২৮, ৬৯০, ৬৪৮, ৬৯৭ ও ১২০ বাংলাদেশি আটক হন বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা খবর দিয়েছে।
প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে ঠিক কতসংখ্যক বাংলাদেশি আটক ও বন্দী রয়েছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোথাও। তবে বর্তমানে বিশ্বের ৪২টি দেশে কমপক্ষে ২০ হাজার বাংলাদেশি বন্দী হয়ে আছেন। এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। কারণ সরকারের পরিসংখ্যানে শুধু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হওয়াদের তথ্যই আছে। প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা বা যাদের কাছে ডকুমেন্টস নেই তাদের সংখ্যা সেভাবে উঠে আসে না। এর মধ্যেই প্রতিদিন প্রচলিত ও অপ্রচলিত পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। ভাগ্য বদলের আশায় তারা বৈধ পথের পাশাপাশি যাচ্ছেন অবৈধ পথেও। অনেকেই গিয়ে আটক হচ্ছেন সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। আবার অনেকে মেয়াদ শেষে বাড়তি অবস্থান করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগই লুকিয়ে থেকে কাজ করছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। আবার কোনো কোনো বাংলাদেশি জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। প্রবাসের মাটিতে চুরি, মাদক পাচার থেকে শুরু করে রোমহর্ষক খুন পর্যন্ত করছেন বাংলাদেশিরা। অবশেষে ঠাঁই হচ্ছে বিদেশের কারাগারে। নতুন যুক্ত হয়েছে প্রবাসে মাদক ব্যবসার সঙ্গে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া। ঢাকার একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, গত ১০ বছরে সরকারের পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আটক ও বন্দীর সংখ্যা ৫ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে উল্লেখ করে সংসদে তথ্য দেওয়া হয়েছে। আবার একই সংসদে লিখিতভাবে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালে বিদেশের কারাগার থেকে সাড়ে ৪৯ হাজার বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার তথ্য দেওয়া হয়। সংসদের নথি অনুসারে, ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রয়ারি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখিত প্রশ্নোত্তরে জানান, বিশ্বের ৪৭টি দেশের কারাগারে ৪ হাজার ৫৩২ জন বাংলাদেশি নাগরিক আটক আছেন। ২০১৪ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় ৭ হাজার ৮৫৯ জন আছেন বিদেশের কারাগারে। ২০১৫ সালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী সংসদে তথ্য দেন বিদেশের কারাগারে আছে ৪ হাজার ৫৭৭ জন। আবার ২০১৬ সালের ৬ জুন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সংসদে লিখিত বক্তব্যে জানান, ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত বিদেশের কারাগার থেকে ৪৯ হাজার ৫০৩ জন বাংলাদেশি মুক্তি পেয়েছেন। তিনি কোন দেশ থেকে কতজন মুক্তি পেয়েছেন তার পরিসংখ্যানও জানান সংসদে। সর্বশেষ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে ৮ হাজার ৮৪৮ বাংলাদেশি আটক থাকার তথ্য সংসদকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৫১ বাংলাদেশি ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী। তাদের মধ্যে কলকাতায় ২ হাজার ৩১ জন। এ ছাড়া সৌদি আরবে ১ হাজার ২৮৯, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ হাজার ১৫৬, বাহরাইনে ৬৯৩, মালয়েশিয়ায় ৫৭২, ওমানে ৪৪২, কাতারে ৩৫১, কুয়েতে ৩১৬, ইরাকে ২৭৫, ইরানে ২৪৩, যুক্তরাজ্যে ১২৬ ও যুক্তরাষ্ট্রে ৭৯ বাংলাদেশি আটক আছেন। গত দুই বছর সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত তাদের কারাগারে আটক ১ হাজারের মতো বাংলাদেশিকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সিরিয়া থেকেও ফেরত পাঠানো হয়েছে অর্ধশত বাংলাদেশিকে। মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস কর্তাদের দাবি, পাসপোর্ট ভিসার জটিলতা ও অপরাধের কারণে কারাগারে যাওয়া দুই ধরনের বিষয় হিসেবেই ধরা হয়। আবার সব সময় কতজন বাংলাদেশি বিদেশের কারাগারগুলোয় বন্দী বা আটক আছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াও কঠিন। আটকদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করলেই কেবল তাদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়। বিদেশে কোনো নাগরিক কারাগারে গেলে অনেক সময় দেশ থেকে স্বজনরা ঢাকায় প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে থাকেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মিশন থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। আবার কারাগারে আটক ব্যক্তিরা ছাড়া পেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বজনদেরই বিমান ভাড়া বহন করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লেগে যায়। এ ছাড়া এক এক দেশের আইন একেক রকম। আইনি পদক্ষেপ শেষে কারাগার থেকে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারে অনেক সময় লেগে যায়। আইনগত জটিলতা থাকার কারণে অনেকে সহজেই কারাগার থেকে মুক্তি পান না। অনেক দেশে নেই মিশনও। তাই তালিকার বাইরেও থেকে যান অনেক বন্দী। তবে খোঁজ পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উদ্ধারের গতি শ্লথ হলেও চেষ্টা ও উদ্যোগ উভয়ই আছে সরকারের।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কূটনীতিকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে মদ, গাঁজা ও ইয়াবা সম্পর্কিত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে মাদক ব্যবসা সর্বোচ্চ সাজার অপরাধ সেখানে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়াকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন তারা। কারণ শ্রম আইনবিষয়ক কিছু হলে আইনি সহায়তা করা হয়। কিন্তু ফৌজদারি কোনো অপরাধ হলে সেভাবে আইনি সহায়তার সুযোগ থাকে না।
সৌদি আরব থেকে ফৌজদারি অপরাধী ৬০৩ বাংলাদেশিকে ফেরানোর উদ্যোগ : দূতাবাসের দেওয়া তথ্যমতে, সৌদি আরবের মালাজ জেলে ৯৭, আল হায়ের জেলে ১৮৭, দাম্মাম সেন্ট্রাল জেলে ১৫৬, আল হাসা জেলে ৩১, আল খোবার জেলে ৩৩, আল জোবাইল জেলে ৪৯, কাতিফ জেলে ১২, হাফার আল বাতেন জেলে ১৯, হাইল জেলে ১৮, বুরাইদাহ জেলে ১৮, কুরাইয়াত জেলে ১, আরার জেলে ৩, সাকাকা জেলে ৬ জন বাংলাদেশি আটক রয়েছেন। তাদের সবার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এদের কেউ রেসিডেন্সি আইন বা লেবার আইন ভঙ্গের কারণে ডিপোর্টেশন সেন্টারের নন। এদের জন্য দূতাবাস থেকে সৌদি সরকারকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বা দ্রুতই শেষ হবে, তাদের স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যাদের সাজার মেয়াদ এক-চতুর্থাংশ শেষ হয়েছে তাদের উত্তম ব্যবহারের ভিত্তিতে অবশিষ্ট সাজা মওকুফ করে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। যারা প্রথম অপরাধে আটক হয়েছেন তাদের সাজার মেয়াদ মওকুফ করে দেশে পাঠানো যায়। যারা তুচ্ছ ও ছোট অপরাধে আটক হয়েছেন তাদেরও সাজা মওকুফ করে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। এখন সৌদি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর বাকিটা নির্ভর করছে।