‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) সরকারের প্রতিনিধি। তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয়ও করেন তারা। সম্প্রতি নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের না জানিয়ে বিভিন্ন বাহিনী আলাদাভাবে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভা আহ্বান করছে। সেখানে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, যা রুলস অব বিজনেস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্বাচন কিংবা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা সভা আয়োজনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন মানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২৭ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়- ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’-এর শিডিউল-১ (অ্যালোকেশন অব বিজনেস অ্যামাং দ্য ডিফারেন্ট মিনিস্ট্রিস অ্যান্ড ডিভিশন) অনুযায়ী সারা দেশের বিভাগীয় কমিশনার বিভাগে, ডিসি জেলা পর্যায়ে ও ইউএনও উপজেলা পর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয়ও করেন তারা। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা পর্যায়ে ডিসি এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও-কে সভাপতি করে আইনশৃঙ্খলা কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব কমিটি প্রতি মাসে সভার আয়োজন করে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিং ও সমন্বয় করেন। জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ সভার আয়োজনের মাধ্যমে যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ সমন্বয় করেন। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ডিসিকে না জানিয়ে বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক আলাদাভাবে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভা আহ্বান করা হচ্ছে। সেখানে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। বিষয়টি রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর বিধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনার পরিপন্থী। এ ধরনের সভা আহ্বানের ফলে সরকারি আদেশসহ বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এতে জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়- নির্বাচন কিংবা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা সভা আয়োজনের ক্ষেত্রে রুলস অব বিজনেস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়। চিঠির কপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশনসহ মাঠ প্রশাসনের সব কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞ আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে যদি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভা হয় এ বিষয়ে অবশ্যই ইউএনও-ডিসিদের জানাতে হবে। তাদের নেতৃত্বেই এসব সভা হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সার্কুলারই সঠিক। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সে অনুযায়ী যথাযথভাবে কাজ করতে হবে।’ এর আগে জুলাইয়ে গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুজিববর্ষের উপহার দুর্যোগসহনীয় ঘর ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়ম তুলে ধরে গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রচারিত হয়। এতে মাঠ প্রশাসনের পাঁচজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হলে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন সরকারের সংশ্লিষ্ট শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। তখনো রুলস অব বিজনেস লঙ্ঘন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে না জানিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে নানা নির্দেশনা দেয় এবং তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করে। এতে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে রুলস অব বিজনেস মানতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ বিষয়ে ৯ আগস্ট পাঠানো চিঠিতে বলা হয়- ‘সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং অধিদফতর/সংস্থা কর্তৃক বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সম্পর্কে অবহিত না থাকায় নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর শিডিউল-১ (অ্যালোকেশন অব বিজনেস অ্যামাং দ্য ডিফারেন্ট মিনিস্ট্রিস অ্যান্ড ডিভিশন) অনুযায়ী বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাধারণ প্রশাসন এবং আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কার্যপরিধিভুক্ত। এ ক্ষেত্রে মাঠ প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কোনো কমিটিতে অন্তর্ভুক্তকরণের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মতি গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মতি ও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া অধিদফতর বা সংস্থা কর্তৃক সরাসরি এ ধরনের কোনো কমিটি গঠন সমীচীন নয় বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন না হয়ে থাকলে বিভিন্ন বাহিনী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নয়। তাদের উচিত নিজেদের কার্যপরিধির মধ্যে থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করা। তাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।’
মন্ত্রিপরিষদ-সূত্র জানান, এর আগে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর একই বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সে পরিপত্র জারির পর কিছুদিন নির্দেশনা মানা হলেও আস্তে আস্তে তা শিথিল হয়ে যায়। এমনকি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জরুরি প্রয়োজনে মোবাইল বা টেলিফোনেও পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দফতর থেকে জানানো হচ্ছে, স্যার অমুক মিটিংয়ে ব্যস্ত বা জুমে মিটিং করছেন। অথচ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কেউ অন্য মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের কোনো মিটিংয়ে থাকলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে আগেই অবহিত করে অনুমতি নিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিসি ও ইউএনও বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী তারা মাঠে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনসহ আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত যে কোনো সভা আহ্বান করার এখতিয়ার ডিসি-ইউএনওদের। দেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে। এসব নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের না জানিয়ে কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভা আহ্বান করছেন। সেখানে জনপ্রতিনিধি, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও গণমাধ্যমকর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।