জাতীয়

কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ মওদুদের কর্ম ও জীবনদর্শন

বিশেষ প্রতিবেদক:মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার: সোনারগাঁ টাইমস ২৪ ডটকম :

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) সন্ধ্যায় মারা গেছেন। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সিওপিডি রোগে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

দেশের প্রবীণ রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কখনো ছিলেন নন্দিত, কখনো নিন্দিত। ব্যক্তি জীবনে অনেক রাজনৈতিক দলের সাথে সহমত পোষণ করে রাজনীতি করে গেছেন।

মওদুদের জন্মগ্রহণ

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ২৪ মে ১৯৪০ সালে নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এবং মা বেগম আম্বিয়া খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে মওদুদ আহমেদ ছিলেন চতুর্থ।

কী কারণে রাজনীতিতে মওদুদ ?

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মওদুদ আহমদ। এই ঘটনায় তাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। এরপর থেকে মনের অজান্তে রাজনীতিতে সচেতন হন। ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির নেতা ছিলেন।

পেশাজীবী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে নানা ভূমিকায় নিজেকে রেখেছিলেন রাজনীতির কক্ষপথেই। বিএনপি আর জাতীয় পার্টি গঠনে পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। কারাভোগ করেছেন পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু, এরশাদ, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের আমলে।

মুক্তিযুদ্ধে মওদুদ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার মওদুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিকে বাংলাদেশে আনতে রেখেছিলেন ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠকের ভূমিকা ছাড়াও ব্যারিস্টার মওদুদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করে মুজিবনগর সরকার। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকেও তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে।

রাজনৈতিক জীবনে মওদুদ

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলে মওদুদ আহমদ দায়িত্ব পান উপদেষ্টার। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে গঠিত জাগদলের ১৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। পরে জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বিএনপি গঠিত হলে সে কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মওদুদ।

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মওদুদ। কর্মসূচির বিরোধিতা করাসহ নানা কারণে তাকে মন্ত্রীসভা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন জিয়া। কয়েকজন বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। অন্যদিকে দলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ৮৫ সালের ২৫ জুন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন মওদুদ আহমদ।

এরশাদ আমলের প্রথম দিকে তিনি ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই এরশাদ সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্ব পান। সেই সঙ্গে জাতীয় পার্টি গঠনে পালন করেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা।

১৯৮৫ সালে মওদুদ যোগাযোগমন্ত্রী, ৮৬ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী, ৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব পালন করেন। ৮৯ সালে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ পান। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে কিছু সময়ের জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন এবং পরবর্তী অস্থায়ী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে মওদুদ আহমদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের ভারপ্রাপ্ত নেতার দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালেও তিনি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাঁচবার মওদুদ আহমদ নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত হন। তারপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্তবিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংবিধান সংশোধন ও বেশকিছু আইন প্রণয়নে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং এজন্যে তিনি তীব্রভাবে সমালোচিতও হয়েছিলেন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাশ করে মওদুদ ব্রিটেনের লন্ডনস্থ লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার-এ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনে পড়াশুনা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন।

মওদুদ রাজনীতির পাশাপাশি একজন শিক্ষক হিসেবও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউস, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, ফেয়ারব্যাংক এশিয়া সেন্টার এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান ইনস্টিটিউটের ফেলো। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

মওদুদের রচনাসমূহ

মওদুদ আহমদ রচনা করেছেন এক ডজনের বেশি বই। যার মধ্যে রয়েছে- ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ : এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’, ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ’, ‘সাউথ এশিয়া: ক্রাইসিস অব ডেভেলপমেন্ট দি কেস অব বাংলাদেশ’।

‘বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ১৯৯১ থেকে ২০০৬’, ‘চলমান ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা’, ‘কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮’, ‘সংসদে যা বলেছি’, ও ‘ইন লাভিং মেমোরি অব আমান মওদুদ, হিজ লাইফ অ্যান্ড আর্ট’।

প্রসঙ্গত, মওদুদ আহমেদ পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের জামাতা ছিলেন।

Related Articles

Back to top button