বয়স তখন সবে দুই। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা হারান আহাদ। প্রতিবন্ধী শব্দটি বোঝার বয়সও হয়নি তাঁর। কোলে কোলে সময় কেটে যেত। বড় হতে হতে আর দশটা ছেলের মতো ছুটতে না পারার কষ্ট পেয়ে বসে। খেলাধুলায় সমবয়সীরাও এক পায়ের আহাদকে এড়িয়ে চলত। তবে ভেঙে পড়েননি আহাদ। কষ্ট বুকে চেপে নিজের চেষ্টায় জয় করেছেন বাধা। এখন এক পায়ে ক্রিকেট নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরছেন মা–বাবার প্রতিবন্ধী এই ছেলে।
আহাদের পুরো নাম আহাদুল ইসলাম। বর্তমানে বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের অন্যতম অলরাউন্ডার তিনি। চট্টগ্রাম দলের অধিনায়কও। ২০১৬ থেকে নিয়মিত দলের সদস্য। ২০১৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ দলের হয়ে ভারত সফরে যান আহাদ। সেখানে ভারতের সঙ্গে দুটি টি-২০ ম্যাচ খেলেন। দুটিতেই জেতেন তাঁরা। একটিতে আহাদ ম্যাচসেরার পুরস্কার পান। এরপর ক্রিকেট নিয়ে আরও একবার ভারত এবং দুবার নেপাল যায় আহাদদের হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল। জানুয়ারিতে আবার ভারতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
আহাদ বলেন, ‘ভারতে দুইবারই আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। এ ছাড়া নেপালে তিন জাতি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছি ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে একই দেশে এশিয়া কাপ ক্রিকেটে অংশ নিয়েছি। কখনো চিন্তা করিনি পা–হারা গ্রামের আমি ক্রিকেট নিয়ে বিদেশে যেতে পারব। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন আমাকে এ সুযোগ করে দিয়েছে।’ তবে সাফল্যের পেছনে আক্ষেপও আছে। আহাদ বলেন, ‘আমাদের হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তাদের স্বীকৃতি পেলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।’
আহাদকে নিয়ে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম আলোয় ‘এক পায়ের সংগ্রাম’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁকে হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল খুঁজে নেয় বলে আহাদ জানান।
আহাদের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার বরুমছড়া এলাকায়। বাবা আলী আকবর দরিদ্র কৃষক। তাঁদের নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। মা পাটি বানান। অভাব–অনটনের সংসার। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে আহাদ বড়। পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়। প্রতিবন্ধী হলেও আহাদকে পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করার সাধ ছিল আহাদের মা–বাবার। আহাদ সেই পথে হাঁটছেন।
এ বছর চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে আহাদ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। এর আগে আনোয়ারা শহীদ বশিরুজ্জামান উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর ওমরগণি এম ই এস কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। এখন স্নাতকোত্তর করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।
তবে পড়ালেখার চেয়ে খেলাধুলা তাঁকে ছোটবেলা থেকে বেশি টানত। কিন্তু সেখানে বড় বাধা সমবয়সী ছেলেরা। সংগ্রামের এ অংশ শোনা যাক আহাদের মুখে, ‘দুই বছর বয়সে নানাবাড়িতে যাওয়ার সময় একটি গাড়ি পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় বলে শুনেছি। এরপর ডান পা ঊরু থেকে কেটে ফেলে। ছোটবেলা থেকে ক্রাচ নিয়ে চলি। আমাকে কেউ খেলাধুলায় নিত না। তখন আমি নিজে নিজে বাড়ির উঠানে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। এভাবে ৯-১০ বছর বয়সের পর যখন ছেলেরা দেখছে তাদের মতো খেলতে পারি, দৌড়াতে পারি, তখন আমাকে খেলায় নিতে শুরু করে।’
আহাদের মা মনোয়ারা বেগম ছেলের সাফল্যে খুশি। প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলের ভাগ্য খারাপ। খেলাধুলার একটু বেশি পাগল। ছোটবেলা থেকেই সে ছুটেছে খেলার পেছনে। খেলাধুলার জন্য সে বিদেশেও যেতে পেরেছে। এটা তার নিজের ইচ্ছায় হয়েছে।’
আহাদ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিকে প্রতিদিন বরুমছড়া থেকে তিনটি গাড়ি বদলে ওমরগণি এমইএস কলেজে আসতেন। এখন শহরে থাকেন। টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতেও টাকা পাঠান বলে জানান মনোয়ারা বেগম।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সিআরপি একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করে দিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বাস–রিকশায় চড়ার সময় নড়াচড়ায় তাতে স্বস্তি কম পান। তবে মাঝেমধ্যে এখনো কৃত্রিম পা ব্যবহার করেন তিনি।
নিজেকে কোনোভাবেই অস্বাভাবিক কিংবা পিছিয়ে পড়া ভাবতে রাজি নন আহাদ। তাঁর মনোবলের কাছে হার মেনেছে তাঁর প্রতিবন্ধিতা, ‘আমি ক্রাচে ভর দিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো প্রায় সবকিছু করতে পারি।’ বলেই একগাল হাসি দিলেন।