নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে শুরু হলো মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। দেশের হারিয়ে যাওয়া লোকজ ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করে দিতেই প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে প্রতিবারের ন্যায় এবার ৩৩তম আয়োজন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) বিকেলে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের ময়ূর পঙ্খী লোকজ মঞ্চে এই মেলার উদ্বোধন করেন প্রাধান অতিথি নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন সোনারগাঁয়ের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ্-আল-কায়সার হাসনাত। এই মেলা চলবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, লোকজ মঞ্চে আসন গ্রহণ ও অতিথিবৃন্দকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ক্রেস দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমেদে, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) মো: ইমরুল চৌধুরী, পুলিশ সুপার, ঢাকা রিজিয়ন, ট্যুরিস্ট পুলিশ মো: নাইমুল হক পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-সার্কেল) শেখ বিল্লাল হোসেন, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. নুরুন্নবী, সেনারগাঁ উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সভাপতি এ্যাড. সামসুল ইসলাম ভূঁইয়া, উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিপন দেবনাথ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইব্রাহিম, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুম, মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি, সোনারগাঁ পৌরসভা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তৈবুর রহমানকে।
লোকজ মেলায় উদ্ধোধনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কাজী নুরুল ইসলাম, সনমান্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদ হাসান জিন্নাহ, সোনারগাঁ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার সোহেল রানা, সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু, সোনারগাঁ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম রাশেদ, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সাগর, সোনারগাঁও পৌরসভা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাজী তৈয়বুর রহমান, সোনারগাঁ উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার ফেন্সি, সোনারগাঁ থানা ওসি (তদন্ত) মো.মহসিন, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) একেএম আজাদ সরকার প্রমূখ।
প্রাধান অতিথি নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন সোনারগাঁয়ের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ্ আল কায়সার হাসনাত বলেন, বাংলার হারিয়ে যাওয়া চারু ও কারুশিল্পীদের আদি ঐতিহ্য সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। তার প্রত্যাশা, ১৬৮ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত লোকশিল্প জাদুঘর ও পাশের পানাম সিটিকে সঠিকভাবে সাজানো গেলে সোনারগাঁ পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী বাজেটে সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
ইতিহাসে রয়েছে, ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সোনারগাঁয়ে প্রথম প্রাচীন বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট সুলতান ইসলাম খাঁর আমলে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর হয়। সোনারগাঁয়ের পানাম সিটি ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করেন ঈশা খাঁ।
এসব ইতিহাস দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জানতে সহজ ব্যবস্থা নিতে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালককে নির্দেশ দেন তিনি। বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ একটি নগর হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দিবো আমরা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের একটি অঙ্গীকার হচ্ছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শহরের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিয়ে গ্রাম হবে শহর। ফলে শহরমুখী মানুষের ঢল রোধ করা হবে।
এবারের মেলায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ৫০ জন কারুশিল্পী ১০০টি স্টলে অংশ নিচ্ছেন। এই আয়োজনে রয়েছে ঝিনাইদহের শোলা শিল্প, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, চট্টগ্রামের নকশী পাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁওয়ের পাটের কারুশিল্প এবং হাতি-ঘোড়া পুতুল ও কাঠের কারুশিল্প, নকশীকাঁথা, নকশী হাতপাখা, মুন্সীগঞ্জের শীতল পাটি ও পটচিত্র, মানিকগঞ্জের তামা-কাঁসা পিতলের কারুশিল্প, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারু পণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্প, নাটোরের শোলার মুখোশ শিল্প, ঢাকার কাগজের হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন চারু ও কারুপণ্য।
এবারের মেলার আকর্ষণ গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম ‘ভালোবাসার তামা-কাঁসা-পিতল শিল্প’ বিশেষ প্রদর্শনী। এ উপলক্ষে গবেষণামূলক একটি ক্যাটালগ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ। এছাড়া হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ খেলাধুলা লাঠি খেলা, দোক খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, লোকজ জীবন প্রদর্শনী, লোকজ গল্প বলা, পিঠা প্রদর্শনী থাকবে প্রতিদিন।
প্রতিদিন কারুমঞ্চে পরিবেশিত হবে বাউলগান, পালাগান, কবিগান, জারি-সারি, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালী গান। দেশের প্রায় চার হাজারের বেশি শিল্পী এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।
ঢাকা থেকে গুলিস্তান হয়ে নারায়ণগঞ্জে আসা যায় সহজে। এরপর অটোতে চড়ে সোনারগাঁও পৌঁছালেই চোখে পড়বে লোককারুশিল্প জাদুঘর।