আন্তর্জাতিক

‘পৃথিবীর নরক’ দেখতে যাচ্ছে আফগানরা

অনলাইন নিউজ ডেস্ক, সোনারগাঁ টাইমস২৪ ডটকম :

আফগানিস্তান এখন এমন একটি দেশ যেখানে ক্ষুধার ভয় মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে জেঁকে বসেছে। শীতকাল যতই এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে সেই শঙ্কা। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক এলাকা খরার কবলে পড়েছে। ফলে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালেবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে আফগানেরা।

রাজধানী কাবুল থেকে ৫০ মাইল দূরের এলাকা মাইদান ওয়ারদাক। সরকারি গমের আটা বিতরণ পয়েন্টে শত শত মানুষ ভিড় জমিয়েছেন আটা পাওয়ার আশায়। ওই আটা সরবরাহ করে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি)। আটা নিতে আসা লোকজনের চোখে-মুখে হতাশা ও ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি। উপস্থিত মানুষকে শান্ত করতে তালেবানের সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন।

আটা নিতে আসা একজন বলেন, ‘এখানে শীত প্রায় চলে এসেছে। আমরা জানি না, কীভাবে আমরা আটা পাব, যা দিয়ে রুটি তৈরি করব। জীবন বাঁচাতে এই আটায় তাঁদের একমাত্র সম্বল।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখের বেশি আফগানকে সাহায্য করতে হিমশিম খাচ্ছে ডব্লিউএফপি। এরপর যদি সামনের দিনগুলোতে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। শীতের সময় আবহাওয়া খারাপ হওয়ার যে আভাস বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, সেটা যদি হয় তাহলে বিপুল সংখ্যা মানুষের মারাত্মক ক্ষুধায় ভুগবে এবং সুদূরপ্রসারী দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।

গত রোববার কাবুল সফরে আসা ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলেই বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ হলো, পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক। বিসলেই বলেছেন, ‘আমরা যেটা মনে করছি, পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। সত্যি বলতে, আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক সংকট দেখতে যাচ্ছি।’

বিসলেই আরও বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের ৯৫ শতাংশ মানুষের পর্যাপ্ত খাবার নেই। এখন ২ কোটি ৩০ লাখ লোককে অনাহারের দিকে ধাবিত হওয়া দেখতে যাচ্ছি। আগামী ছয় মাস বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। এটা পৃথিবীর নরক হতে যাচ্ছে।’

গত আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের আগে দেশটিতে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার আসন্ন শীতকালীন সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তা পাঠাবে। কিন্তু গনির সরকারের পতন আর তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। দেশগুলো মনে করছে, এখন যদি সহায়তা পাঠানো হয়, তাহলে সেটা তালেবানের হাতে পড়বে। এতে কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং লাভবান হবে তালেবান। সেই কারণে সাধারণ আফগানরা নানা ধরনের সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না দেশগুলো।

কিন্তু আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, সেই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আফগানদের পাশে এসে দাঁড়ানো। মারাত্মক অনাহারের মুখে থাকা লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের জীবন বাঁচানো। এ জন্য উন্নত দেশ ও ধনকুবেরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ডব্লিউএফপির বিসলেই। তিনি বলেছেন, বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে ধনকুবেরদের প্রতি আহ্বান: অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে আপনার ছোট্ট মেয়ে ও ছোট্ট ছেলে, আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানির মৃত্যুর কথা আপনারা কল্পনা করুন। আপনাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কিছু করা উচিত। ৪০০ ট্রিলিয়ন সম্পদের আজকের এই দুনিয়ায় এভাবে মানুষের মৃত্যু আমাদের জন্য লজ্জার।’

বিসলেই বলেছেন, ‘আমরা যদি অনাহারে কোনো শিশুকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেয়, সেটা হবে আমাদের জন্য চরম লজ্জার।’

তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর অনেক লোক চাকরি হারিয়ে বেকার। একমাত্র উপার্জনের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবারের খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামের চিত্রই একই।

আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলের শহর বামিয়ান। ২০০১ সালে তালেবান এই শহরের প্রাচীন নিদর্শন ও মনোমুগ্ধকর বুদ্ধের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। বিবিসির সাংবাদিকেরা ওই শহরে বসবাস করা স্বামী হারানো ফাতেমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সাত ছেলে-মেয়ে। তাদের বয়স ৩ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। অনেক দিন আগে ফাতেমার স্বামী মারা গেছেন ক্যানসারে। এরপর থেকে পরিবারটির দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। তাঁরা পাহাড়ের একটি ছোট গুহায় বসবাস করে।

আগের সরকারের সময় ফাতেমা প্রয়োজন মতো আটা ও তেল পেতেন। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই সরবরাহ বন্ধ। ফাতেমা অন্যের খেতে কাজ করে সামান্য অর্থ উপার্জন করতেন। আর তা দিয়েই কোনোমতো চলত তাঁর সংসার। কিন্তু এখন সেই সুযোগও নেই। খরার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে তাঁর আর কাজও নেই। ফাতেমা বলেন, ‘আমি খুবই ভয়ে আছি। আমার ছেলে-মেয়ের মুখে তুলে দেওয়ার মতো কোনো কিছুই নেই। শিগগিরই হয়তো আমাকে ভিক্ষা করতে হবে।’

অনেক মা-বাবা খেতে দিতে না পেরে বিয়ের নামে বয়স্ক লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মেয়েকে। কিন্তু ফাতেমা সেটা করতে নারাজ। তবে খাদ্য সরবরাহ চালু না হলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁকে অনাহারে কাটাতে হবে দিন। এমনকি ক্ষুধায় জীবনও যেতে পারে তাদের।

ফাতেমা যে পার্বত্য এলাকায় থাকেন সেখানে ইতিমধ্যে তুষার পরতে শুরু করেছে। বাতাসের তীব্রতাও বেড়েছে। শীতকাল শিগগিরই চলে আসবে এখানে। ফাতেমার মতো অনেক পরিবারের জন্য সামনে ভয়ংকর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

Related Articles

Back to top button