পুলিশসোনারগাঁয়ের খবর

সোনারগাঁয়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

আনোয়ার হোসেন, সোনারগাঁ টাইমস২৪ ডটকম :

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে একের পর এক খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। অপরদিকে পুলিশকর্তৃক সাংবাদিকদের হুমকি ও মিথ্যা মামলায় জাড়ানোসহ আইন শৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশে জনপ্রতিনিধিদের মাঝে চরম উদ্বেগ ও সাধারণ মানুষের মাঝে উৎকণ্ঠা সব মিলিয়ে সোনারগাঁয়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদকদ্রব্যসহ প্রায় সকল অপরাধ ও অপরাধীদের দৌরাত্ম্য আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অপরাধ চিত্র প্রমান করছে অপরাধীরা পুলিশ প্রশাসনকে তোয়াক্কা তো করছেই না উল্টো বৃদ্ধাঙলী প্রদর্শন করে চলছে। যে কারনে জনসাধারনের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার ভীতি ও উদ্বেগ।

ঘটে যাওয়া লোম হর্ষক অনেক ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের দমন করতে পারছেনা। অপরাধীদের বেশির ভাগ থেকে যাচ্ছে ধরা ছোয়ার বাইরে।

এব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ যথেষ্ট তৎপর ও সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করছে। তবে বেশির ভাগক্ষেত্রে যে কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারপরও অপরাধীদের ধরার জন্য পুলিশি তৎপরতার কোন ঘাটতি নেই।

সোনারগাঁবাসীর ভাষ্যমতে, যেকোন হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর পুলিশ প্রশাসনকে কিছুটা নড়াচড়া করতে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিটি হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ প্রশাসন কতটা সফল হতে পারে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন থেকে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা, গত ২৪ সেপ্টেম্বর পরকিয়ার জেরে কাঁচপুরের চেঙ্গাইন এলাকার দলিল লিখক মোশারফ হোসেনকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে বালতির পানিতে চুবিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার করে স্ত্রীর শাহিনুর আক্তার ও পরকিয়া প্রেমিক রিপন মিয়া।

কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে ততকালিন ওসি মোরশেদ এক সাংবাদিককে বিএনপির রাজনৈতিক মামলায় জড়ান। অজানা সেই মামলায় গত ১৬ নভেম্বর ২০২২ইং বুধবর রাত দুইটায় ১৫-১৬ পুলিশ সাংবাদিকের বাড়িঘর ঘেরাও করে তাকে গ্রেফতার করে সোনারগাঁও থানায় নিয়ে পরে কোর্টে চালান করে।

ভুক্তভোগী সেই সাংবাদিকের নাম মো. শাহজালাল। তিনি দৈনিক আমাদের নতুন সময় পত্রিকার সোনারগাঁ প্রতিনিধি। তিনি সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের চেঙ্গাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। তার অপরাধ, সে নির্ভীক সাংবাদিক, অনিয়মের বিরুদ্ধে তার লিখনি ছোট-বড় কাউকে পরোয়া করে না।

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি রবিবার জামপুরে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মী সভায় ডা. আবু জাফর চৌধুরী বিরু ও শিপলু সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ২০ জন আহত হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে পুলিশ কয়েক দফা সংঘর্ষকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেও কর্মী সমর্থকরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে আবারো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ৯ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে মোগরাপাড়া ইউনিয়নের বড় সাদিপুর এলাকায় প্রতিপক্ষের হামলায় একই পরিবারের নারীসহ ৩ জনকে পিটিয়ে জখম করা হয়।

১৯ জানুয়ারি রাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাকুন্ডা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবিরের ছেলেসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করে। সম্পত্তি বিরোধে হামলা চালিয়ে ১৪ জানুয়ারি শনিবার আলাদী এলাকায় কলিমউল্লাহ ও সলিমউল্লাহ নামে দুই রিক্সাচালককে পিটিয়ে আহত ও বাড়িঘর ভাংচুর করে প্রতিপক্ষের লোকজন।

১৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকালে বৈদ্যেরবাজার হামছাদী এলাকায় মিয়ারবিল থেকে আল আমিন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

২৩ জানুয়ারি সোমবার জামপুর ইউনিয়নের কাঠারাবো এলাকা থেকে সোহেল নামের এক ব্যবসায়ী নিখোঁজ হয়। একই দিনে ২৩ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে বারদী ইউনিয়নের পাইকপাড়া চেঙ্গাকান্দি এলাকায় ছিনতাইকারীরা আশা নামে এনজিওর ইউসুফ ও তানিয়া নামে দুই কর্মকর্তাকে কুপিয়ে নগদ টাকা ও মুঠোফোন ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আশা বারদী শাখার ম্যানেজার মো. ইউসুফ আলী বাদী হয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।

২৫ জানুয়ারি বুধবার বিকালে শম্ভুপুরা ইউনিয়নের এলাহীনগর ঈদগাঁ মাঠে কর্মী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। এঘটনায় কর্মী সম্মেলনটি পন্ড হয়ে যায়।

পারিবারিক কলহের জেরে ২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে পিরোজপুর ইউনিয়নের চেঙ্গাকান্দি এলাকায় আঁখি নামে এক গৃহবধূকে হাত, পা বেধে দুই সন্তানের সামনেই হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে তার স্বামী সাইদুল ইসলাম।

৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দিবাগত রাতে সাদিপুর ইউনিয়নের সাদিপুর বড়বাড়ি এলাকায় মাসুম মিয়া নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে দূধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটেছে। চোরের দল ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার, মূল্যবান কাগজপত্রসহ প্রায় ৪ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মাসুম মিয়া বাদি হয়ে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেলে নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাপাড়া মোড়ে এক যুবককে অপহরন করে নির্জন এলাকায় গলায় ছুরি ধরে ভিডিও পোষ্ট করার জেরে ইউপি সদস্য মো. মনিরুজ্জামানকে অপহরণ করে কুপিয়ে পিটিয়ে হত্যা চেষ্টা চালিয়েছে প্রতিপক্ষের লোকজন।

৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাতে সাদিপুর ইউনিয়নের কোনাবাড়ি এলাকায় রতন মিয়া নামে এক চাকুরীজীবির ঘরে চুরির ঘটনা ঘটে। এসময় চোর ঘরে থাকা নগদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় রতন মিয়া বাদী হয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য তাজুল ইসলামের ছেলে শাহ জালালের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।

১০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বারদীর আলমদী ঘটেরপাড়া এলাকায় টিউবওয়েল চুরিকে কেন্দ্র করে তাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে আহত করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন।

১৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সাদিপুর গ্রামে আমিনুল ইসলাম আমান নামের এক কৃষককে পিটিয়ে আহত করেছে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় কৃষক আমিনুল ইসলাম বাদি হয়ে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

১৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে অলিম্পিক বিস্কুট কারখানার এক নারী শ্রমিক গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী শ্রমিকের স্বামী শাহরিয়ার আলম শুভ বাদি হয়ে একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে মমিন, আবু হানিফ ও ফয়সাল নামে ৩ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার দুপুরে জমি সংক্রান্ত বিরোধে ও পানি নিঃস্কাসনের জন্য ড্রেনে পাইপ বসানোকে কেন্দ্র করে কাঁচপুর ইউনিয়নের পাঁচপাড়া এলাকায় আসলাম সানি ও মো. রনি নামে দুই সহোদরকে কুপিয়ে হত্যা করেছে আপন চাচাতো ভাইয়েরা।

১১ মার্চ শনিবার সোনারগাঁয়ে বেড়াতে এসে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছে সরকারি তিতুমীর কলেজের ২৫ শিক্ষার্থী। শনিবার সন্ধ্যায় বেড়ানো শেষে ঢাকায় ফেরার পথে পানাম নগরীর পাশে আমিনপুর মাঠে তারা হামলার শিকার হয়।

১৪ ই মার্চ মঙ্গলবার সাদিপুর ইউনিয়নের গংগাপুর বাজারের পশ্চিমপাশের একটি পরিত্যক্ত জায়গা থেকে রুবেল নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

সর্বশেষ ১৭ মার্চ শুক্রবার সকালে সাদিপুর ইউনিয়নের গজারিয়াপাড়া এলাকা থেকে রোজিনা নামের এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এঘটনায় ১৭ মার্চ শুক্রবার রাতে হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন আসামী সেলিমকে আটক করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে র‍্যাবের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গোলাগুলির সময় গুলিবৃদ্ধ হয়ে আবুল কাশেম নামের এক বৃদ্ধ নিহত হয়। সংঘর্ষ ও গোলাগুলির সময় ১০ জন গ্রামবাসী ও ৪ জন র‍্যাব সদস্য আহত হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, সোনারগাঁয়ে পুলিশ সদস্যরা অপরাধ দমনের চেয়ে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, সামারি আর ঘুষ দুর্নীতিতে বেশি ব্যস্ত থাকেন।

এছাড়া কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চিহ্নিত দাগি সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতা এবং স্থানীয় সুপরিচিত চোর সদস্যরা পুলিশের সোর্স এর ভূমিকায় থাকায় হরহামেশাই দেখা যায় ওই অপরাধীদের অনেকেই অবাধে থানার ভিতরে ঢুকে অথবা বাহিরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়।

আবার পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অপরাধীদের আতিথেয়তা গ্রহন করছেন। যার ফলে অপরাধ বাড়ছে ও দীর্ঘ হচ্ছে অপরাধের তালিকা।

সোনারগাঁ থানার ওসি তদন্ত আহসান উল্লাহ জানান, আগের যে কোন সময়ের তুলানায় সোনারগাঁয়ের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। জন নিরাপত্তায় পুলিশ সব সময় তৎপর ও অপরাধ দমনে পুলিশ সব সময় মাঠে সক্রিয় রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের সহকারি পুলিশ সুপার ও সার্কেল শেখ বিল্লাল হোসেন জানান, সোনারগাঁয়ের আইন শৃঙ্খলা ভাল আছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোন অপরাধীই ছাড় পাচ্ছে না। অপরাধীদেরকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে পুলিশের যা করনীয় পুলিশ তাই করছে।

Related Articles

Back to top button