জাতীয়

ভাড়া বাড়াতে মানুষকে জিম্মি

অনলাইন নিউজ ডেস্ক, সোনারগাঁ টাইমস২৪ ডটকম :

ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে চলাচলকারী বেশির ভাগ বাস সিএনজিচালিত। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বা এসি বাসের ভাড়া কত হবে, তা মালিকেরাই ঠিক করেন। আর পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। ঠিক হয় দর–কষাকষির মাধ্যমে।

প্রশ্ন উঠেছে, ডিজেলের বাড়তি দামের কারণে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে চলা ধর্মঘটের মধ্যে দুই প্রধান শহরে সিএনজিচালিত বাস বন্ধ কেন? এসি বাস এবং পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিকেরাই-বা কেন ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন?

জ্বালানি মন্ত্রণালয় গত বুধবার রাতে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে। এরপর গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে অঘোষিত ধর্মঘট পালন শুরু করেন বাস, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকেরা। এতে সারা দেশে মানুষকে গতকাল শুক্রবার ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ধর্মঘট অনির্দিষ্টকালের। তাই দুর্ভোগ কবে শেষ হবে, তা–ও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

এমন অবস্থায় সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবহন মালিকেরা ভাড়া বাড়াতে মানুষকে জিম্মি করেছেন। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বাসভাড়া নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ নিয়ে বৈঠক ডেকেছে আগামীকাল রোববার, ডিজেলের দাম বাড়ানোর তিন দিন পর। এর মধ্যেই ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছেন মালিকেরা। পরিবহন খাত সূত্রের দাবি, সরকার ভাড়া পুননি৴র্ধারণ করবে, এটা সবাই জানেন। তারপরও ধর্মঘট ডাকা হয়েছে ভাড়া বাড়ানোর বৈঠকে দর–কষাকষিতে এগিয়ে থাকার জন্য। যাতে বাড়ানোর হার মালিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেন বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে, তা মালিকদের জিজ্ঞাসা করুন। ট্রাক ও এসি বাস বন্ধ রাখার বিষয়টি বোধগম্য নয়। ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে রোববারের মধ্যে একটি সমাধান হবে আশা করে তিনি বলেন, জ্বালানির মূল্য ও পরিবহন ভাড়া একসঙ্গে নির্ধারণ করা গেলে ভালো হতো। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেনি।

ধর্মঘট ডাকতে কৌশল

শ্রম আইন অনুসারে, পরিবহন মালিকেরা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারেন, ধর্মঘট ডাকতে পারেন না। আর শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলে অন্তত ১৫ দিন আগে সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দেওয়ার নিয়ম। এ ক্ষেত্রে কোনোটাই হয়নি।

সূত্র জানিয়েছে, আইনের বাধ্যবাধকতা কৌশলে এড়িয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়ে ধর্মঘট পালন করছে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশ না করার শতে৴ একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। সেবার সরকার ভাড়া কমালেও পরিবহন মালিকেরা তা মানেননি। অর্থাৎ পরিবহন মালিকেরা শুধু তাঁদের সুবিধা আদায়ে যাত্রীদের জিম্মি করেন। তিনি আরও বলেন, পরিবহন সমিতিগুলোর শীর্ষ পদে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা রয়েছেন। বিআরটিএর কর্মকর্তারা এসব নেতার সামনে অনেকটাই অসহায়।

যা বললেন তাঁরা

ঢাকা ও চট্টগ্রামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজিচালিত বাস বন্ধ কেন তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতরাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ দুই শহরে সিএনজিচালিত বাস ডিজেলে রূপান্তর করে ফেলা হয়েছে। এসি বাস না চলার বিষয়ে তিনি বলেন, অন্যসব বাস বন্ধ রেখে এসি বাস চালু রাখা অবাস্তব।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৫ সালে সিএনজির দাম বাড়ানোর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মালিকেরা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসের বেশির ভাগ এখনো সিএনজিতেই চলে।

পণ্যবাহী যানবাহনে ধর্মঘট কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি ও প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক, আমাদের সঙ্গে বিআরটিএর ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা ধর্মঘট করছি জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য বাতিলের জন্য।’ তিনি বলেন, বিআরটিএর বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে জ্বালানির দাম কমানোর বিষয়টি নেই। ফলে শিগগিরই ধর্মঘট প্রত্যাহারের সুযোগ নেই।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় গতকাল এক ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) পাঁচ মাসে ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। সংস্থাটি লোকসানে গেলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে নেওয়া প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

সূত্র জানিয়েছে, ডিজেলের দাম কমানোর সম্ভাবনা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল কত দিন বন্ধ থাকবে?

ডিজেল ‘সুযোগ’ করে দিয়েছে

রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত বড় বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা। মিনিবাসের ক্ষেত্রে তা ১ টাকা ৬০ পয়সা। দূরপাল্লার বাসে ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪৫ পয়সা।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১০ পয়সা বাড়ানো হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাস মালিকেরা ২০১৬ সাল থেকেই ভাড়া বাড়ানোর জন্য দেনদরবার করে আসছিলেন। জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লেও তাঁদের যুক্তি ছিল, যন্ত্রাংশ ও ইঞ্জিন অয়েলের দাম বেড়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিবহন মালিকদের ভাড়া বাড়ানোর দাবিকে আড়ালে ফেলে।

ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর কমিটি ২০১৯ সালের শেষের দিকে মালিকদের চাপের মুখে বৈঠক শুরু করে। কমিটির সূত্র বলছে, ওই সময় পরিবহন মালিকেরা ঢাকার অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়ানোর চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিআরটিএ ২০ শতাংশ বাড়ানোর একটি প্রস্তাব তৈরি করেছিল। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর এই ভাড়ার বিষয়টি আর এগোয়নি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, এবার শুধু ডিজেলের বাড়তি দাম নয়, মালিকেরা চান অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ভাড়া অনেকটা বাড়ানো হোক। এ জন্যই তারা চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শতে৴ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল বাড়ানো হয়েছে। পরিবহন মালিকেরা অন্যান্য খরচও যুক্ত করতে চাইছেন। সবকিছু বিবেচনায় নিলে জনগণের ওপর বড় চাপ পড়বে।

এদিকে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থা গতকাল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে ভাড়া দ্বিগুণ করার দাবি করেছে।

মন্ত্রীর আহ্বানে মালিকদের ‘না’

মালিকদের ধর্মঘট চলার মধ্যে গতকাল নিজ বাসা থেকে এক ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবভিত্তিক মূল্য সমন্বয় করা হবে।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো আশ্বাস ছাড়া তো সাধারণ মালিকদের ধর্মঘট থেকে সরানো যাবে না।

‘সরকারই সুযোগ করে দিয়েছে’

ধর্মঘটের কারণে চাকরি ও কলেজের পরীক্ষা দিতে যাওয়া এবং জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে ঘর থেকে বেরিয়ে মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা ছিল গতকাল সকালে। বাস না পেয়ে সকাল সাতটার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের ঢাকাগামী লেন অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সাভার মডেল থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে।

এদিকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সকাল থেকেই যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ধর্মঘট ও মানুষের ভোগান্তির পেছনে সরকারের দায় দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা থেকে অর্থনীতি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এ সময় অন্তত দুই বছর জ্বালানির দাম না বাড়ানো উচিত ছিল। তিনি বলেন, সরকারই মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার এই সুযোগ করে দিয়েছে।

Related Articles

Back to top button