সোনারগাঁ

গল্পঃ উপলব্ধি -মোঃসোহানুর রহমান বাপ্পি

সোনারগাঁ টাইমস ২৪ ডটকমঃ

  • ০১.
    সোনালি প্রান্তর উজ্জল দিগন্ত, প্রকৃতির বিস্তৃত সমাহারে সব কিছুই আছে। পূর্ব দিগন্তে আজও সূর্য উঠছে, নদীর জলধারা ঠিক আগের মতোই আছে,পাখিরাও সকাল হতে ছুটছে এদিক ওদিক,জনশূন্য রাস্তাটাও লোকালয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ঠিক আগের মতোই, আজ শুধু আমার ভেতরটাই সম্পূর্ণ জনশূন্য,মনের চারপাশটাতে যেনো চলছে হাহাকারের জনসমাবেশ।কেউ নাই,কিছুই নাই, কি যেনো নাই ?

    ০২.
    মা,বাবা,ছোটবোন আলো আর আমি সায়েম,পরিবারে আমরা মোট চারজন। গ্রামীন পরিবেশে ছোটবেলা থেকেই বেড়ে ওঠা গ্রীষ্মের রোদ,বর্ষার কর্দমাক্ত মাটি আর শীতের কাঁপুনি সব কিছুকেই হার মানিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে ছুটেছি দিক বিদিক। সবে ক্লাস নাইনে উঠছি, আমাদের স্কুলে ৮ম শ্রেনিতে একমাত্র এ+ পাওয়া ছাত্র আমি। নিয়মিত ক্লাস সারাক্ষণ পড়াশোনা,শিক্ষকদের ভালোবাসা সব কিছুর ভিতর দিয়ে খুব ভালোই চলছে।
    ০৩.
    শনিবার। সেদিন একটা ক্লাসের পর আকাশ,রাহাত আর তপু ওরা তিনজন যেনো হঠাৎ নাই হয়ে গেলো,ওদেরকে খোঁজার জন্য স্যার আমাকে ক্লাসের বাইরে পাঠালো,বাইরে এসে দেখি ওরা তিনজন স্কুলের পিছন পাশের আম গাছের নিচে বসে একান্ত চিত্তে মোবাইলে কি যেনো দেখতেছে। আমি কাছে যেতেই মোবাইলটা বন্ধ করে দিলো,ততক্ষণে আমি দেখে ফেলছি ওরা মোবাইলে কি দেখতেছিলো। আমি বললাম তোরা এগুলা কি দেখছিস,তোদের কতো পাপ হচ্ছে জানিস?
    কথা শেষ না হতেই রাহাত বললো-ওরে আমার সাধুবাবা আইছে,যখন দুমিনিট দেখিয়ে দিবো সব সাধুগিরি ছুটে যাবে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে নিয়ে চলে আসলাম এবং ক্লাস করতে থাকলাম । কিন্তু আমার মন যেনো বারেবার ওই ভিডিওর ভিতরে আলো-আঁধারির মতো খেলা করতে থাকলো।
    ০৪.
    হাজারও অবৈধ চিন্তা নিয়ে সারারাত্র নির্ঘুম এ কাটানোর
    পর যথারিতি পরদিন স্কুলে প্রথম ক্লাসের পর আমিও আর ঠিক থাকতে পারলাম না,যথারীতি যোগ দিলাম রাহাত,অপু আর আকাশের সাথে,কাওকে ভিডিও দেখার কথা না বলা শর্তে দেখতে থাকলাম সেই পাপের সাম্রাজ্য,ডুবে গেলাম এক দুঃস্বপ্নের জগতে। তাৎক্ষনিক পরিবর্তন শুরু হলো দেহের সবচাইতে গোপনীয় অঙ্গে,এতটাই পরিবর্তন শুরু হলো নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না,দৌড়ে চলে আসলাম ক্লাসে। নিজের উপর প্রচুর রাগ আর ঘৃণা সৃষ্টি হতে লাগলো, তারপর সবকিছু এলোমেলো লাগতেছিলো,ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরলাম। ঐদিন রাতে আমার জীবনে ঘটে গেলো এক মহাপ্রলয়,রঙিন দুঃস্বপ্ন আর নষ্ট দুনিয়ার চিন্তা নিয়ে সারারাত যেনো বিভোর হয়ে থাকলাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানা এবং পরনের কাপড় ভেজা এবং শরীরে আলাদা রকমের পরিবর্তন। কিন্তু সব পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে নিয়মিত ক্লাসের ফাঁকে চার বন্ধু মিলে নতুন ভিডিও এর জগতে যেনো হারিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝেই চারজন মিলে স্কুল শেষে ছয়/সাত কিলো দূরে সাইকেলে চলে যেতাম নতুন নতুন কালেকশন আনতে। ওগুলো দেখার পর মনটাকে আর স্থির রাখতে পারি না,ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুরু করতাম মাস্টারভিশনের মতো যঘন্য কাজ।
    ০৫.
    এভাবেই চলছিলো, সবকিছু কেমন যেনো উলট পালাট হতে শুরু করলো আমার জীবনে। শরীরের অবস্থার পরিবর্তন হলো একবারে নিঃশেষ। পড়াশুনা, খেলাধূলা সব কিছু যেনো একবারে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে লাগলো , এমনকি ক্লাস টেন এ উঠার জন্য বাবার সুপারিশ লাগলো। বাবা যেদিন স্কুলে ক্লাস এইটে একমাত্র এ(+) পাওয়া তার ছেলের জন্য কাঁদো কাঁদো গলায় ক্লাস নাইন পাশের সুপারিশ করছিলো আমি সেদিনও বুঝতে পারিনাই আমি কোন দুনিয়াই ডুবে আছি। আমি কেনো এমন হয়ে গেছি,কেনো পড়াশুনা করিনা শিক্ষক আর পরিবারের কোনো পরামর্শ কিংবা শাষণ আমাকে হার মানাতে পারলো না। পরিবারের সাথেও ব্যবহার কিংবা কার্যকালাপের ঘঠলো ব্যাপক অবনতি।
    ০৬.
    সবকিছুর পরেও অন্ধকার জগৎ থেকে কিছুতেই বাহির হতে পারি নাই ।
    এরপর যেটা ঘঠলো ওইটাই ছিলো আমার জীবনের পরিসমাপ্তির শিকড়। আমাদের কয়জনের নিয়মিত ভিডিও দেখা কিংবা হস্তকৌশলের মাধ্যমে যৌন চাহিদা মেটানো এবার বাস্তবিক রুপে ঘঠানোর পর্যায়ে রুপান্তরিত করতে চাইলাম। অনেক যুক্তি, পরামর্শ এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের বান্ধবী নীতু কে নির্জনে ঘুরতে নিয়ে তাকে সবাই মিলে যেটা করলাম তার নাম ধর্ষণ। এতদিনের কাল্পনিক যৌন খিদা বাস্তবিকভাবে মেটানোর পর এখানেই শেষ নয় চিরচেনা সেই বান্ধবীকে আর বাঁচতে দেইনাই,ও যখন মৃত্যুর একদম শেষ পর্যায়ে চিৎকার করতে লাগলো তখন আমার ছোটবোন আলোর কথা মনে পড়ছিলো কিন্তু ততক্ষণে ও চলে গেছিলো ওপারে। মানে সেখানেই ঘঠলো নীতুর জীবনের পরিসমাপ্তি।
    ০৭.
    ঘঠনার পর পালিয়ে ছিলাম কয়েকদিন,তারপর আর থাকতে পারলাম না। সবাই জানাজানির পর পুলিশ যখন আমায় নিয়ে যাচ্ছিলো মা তখন গড়াইতে গড়াইতে কাঁদতেছিলো আর বলছিলো আমার খোকা অমন কিছু করবার পারে না দারোগা স্যার, আমার খোকা ইসব বোঝেনা স্যার,ওরে ছাইড়া দ্যান।নিজেরে তখন সামাল দিতে পারছিলাম না কিংবা বলতেও পারি নাই ওই যঘন্য কাজের অংশীদার আমি ।
    বিচার হলো, বয়স কম থাকায় আমার আর রাহাতের দশ বছর জেল হলো এবং আকাশ আর তপুর বাবা ক্ষমতা আর টাকার জোরে ওদেরকে ছাড়াই নিয়ে গেছিলো। জেলখানার চার দেয়ালে বন্দী জীবনে শুধু কান্না ছাড়া কিছুই মনে আসতো না। বাবা কখনও আমায় জেলখানায় দেখতে আসেনি, কিছুদিন মা আর আলো এসেছিলো। আমায় যখন আলো জিজ্ঞেস করতো ভাইয়া বল তুই এমন কাজ করিস নি? আমি তখন চুপ থাকতাম। ও হয়তো বুঝেছিলো যে, ওই ঘৃণিত যঘন্য কাজে আমি ছিলাম। তাই তো আর কখনও মা আর আলো আমায় দেখতে জেলখানায় আসেনি।
    আমার চাচাতো ভাই রাসেল মাঝে মাঝেই আসতো আমায় দেখতে। ও বলছিলো আমার একমাত্র বোন আলোর নাকি বিয়ে ঠিক হইছিলো,পরে বরপক্ষ জানতে পারলো ওর ভাই ধর্ষক। ওরা বিয়েটা ভেঙে দিলো,আমার সহজ সরল বোনটা লজ্জা আর ঘৃণা সইতে না পেরে আত্নহত্যা করে নিজের জীবনটা শেষ করে দিলো। বাবা ও ওইবার হার্ট অ্যাটাক এ বিছানায় পড়ে যায়,কিছুদিন পর বাবাও আমার বোন আলোর মতো দুনিয়া ছেড়ে অন্ধকার পরপারে পাড়ি জমায়।
    ০৮.
    বছর পাঁচেক পর আবারও রাসেল আসলো জেলখানায় মুখটা গম্ভীর করে । বুঝতে বাকী রইলো না আমার একমাত্র মা ও হয়তো বিদায় নিছে,তাই খবরটা দিতে আসছে। হুম সেদিনই মা বিদায় নিয়েছে আর বিদায় বেলায় নাকী আমায় খুব দেখতে চেয়েছিলো এবং আমার নাম ধরে অনেক চিৎকার করে ডাকছিলো।
    যে মা আমাকে খোকা ছাড়া কখনও ডাকে নাই, ওইদিন নাকি আমার নাম সায়েম বলে অনেকবার চিৎকার করে ডাকছিলো। কথাগুলো আমায় রাসেল বলতেছিলো আর নিরবে আমার সামনেই কান্না করেছিলো ওইদিন।ওর কান্নার আওয়াজ আর মায়ের চিৎকারের অনুভুতি আমার বুকের ভেতরটা যেনো ফেটে চৌচির হয়ে গেলো ।

    ০৯.
    নিজের প্রতি নিজের খুব ঘৃণা,অবহেলা আর ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করে,নিজেকে শেষ করে দেওয়ার অনেক চেষ্টা ও করেছি, কিন্তু বারবার ব্যার্থ হয়েছি। জেলখানায় থাকা প্রত্যেকটা মূহুর্ত কেটেছে নিজের উপর নিজের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা পোষন করে। সর্বশেষ নিজের ভুল যখন বুঝতে সক্ষম হয়েছি তখন আমার আর হারানোর কিছুই নেই, সব আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।
    ১০.
    দীর্ঘ দশ বছর পর গতকাল ছাড়া পেয়ে
    আজ শুক্রবার সকাল বেলা বাহির হয়েছি, চিরচেনা সেই সোনালি প্রান্তর, উজ্জল দিগন্ত, প্রকৃতির বিস্তৃত সমাহারে সব কিছুই আছে। পূর্ব দিগন্তে আজও সূর্য উঠছে, নদীর জলধারা ঠিক আগের মতোই আছে,পাখিরাও সকাল হতে ছুটছে এদিক ওদিক,জনশূন্য রাস্তাটাও লোকালয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ঠিক আগের মতোই, আজ শুধু আমার ভেতরটাই সম্পূর্ণ জনশূন্য,মনের চারপাশটাতে যেনো চলছে হাহাকারের জনসমাবেশ।
    কারন আজ আমার কেউই নাই কিছুই নাই আমার আশ্রয় স্থলের মতো এক টুকরা শুকনা ছাই ও অবশিষ্ট নাই ।কোথাই আমার সেই ঘর? কোথাই আমার সেই ছোট্ট আদরের বোনটা? আমার ভরসা এবং আস্থার কেন্দ্র আমার প্রিয় মা,বাবা তারা আজ কোথায়? কেউই নাই। আমার হারাবারও আর কিছু নাই।
    একটি ভুলই আমার জীবনে সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।
    আজ থেকে শুরু করবো নতুন এক জীবন, ঢাল হয়ে দাড়াইতে চাই প্রত্যেকটি মায়ের সন্তানের পাশে,কেউ যেনো এই অন্ধকার জগতে ভুল করেও
    মিশতে না পারে।
    আল্লাহ ক্ষমা করে দিও আমায়। আর কখনই যেনো তোমার সরল পথ হতে বিচ্যুত না হই, তোমার এবাদতের মাধ্যমে কাটাইতে পারি বাকী সংক্ষিপ্ত জীবনটুকু।

    =০=

Related Articles

Back to top button